উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ‘আওয়ামী লীগ ফিরে আসবে’ বলে মন্তব্য করেছেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের এক নেতার কাছ থেকে এমন অভিযোগ পেয়ে তাকে তাৎক্ষণিক প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন জনপ্রশাসন সচিব। ফরিদপুরের সদরপুরের সেই ইউএনও আল মামুনকে বদলির জন্য রিলিজ দেয়া হয়েছে।
তবে, এটি প্রত্যাহার নয়, ‘পদোন্নতি দিয়ে বদলি’ বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
আল মামুন গাইবান্ধার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করবেন। এটি প্রশাসন ক্যাডারে ইউএনও (সিনিয়র সহকারী সচিব) পদের আরেক ধাপ ওপরের পদ।
জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান মোল্লা গণমাধ্যমকে বলেছে , মি. মামুনকে নিয়ে অভিযোগ ওঠার আগেই তার বদলির আদেশ হয়েছিল।
“প্রশাসনিক নিয়ম অনুযায়ী জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে রিলিজ (অবমুক্ত) দেয়া হয়েছে,” যোগ করেন মি. মোল্যা।
বর্তমানে সহকারী কমিশনার (ভূমি) রুবানা তানজিন ভারপ্রাপ্ত হিসেবে সদরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন।
কী হয়েছিল সেদিন?
গত বুধবার জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্যদের সাথে ফরিদপুরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মতবিনিময় সভা হয়। সেখানে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রতিনিধি আনিসুর রহমান সজল সদরপুরের ইউএনও আল মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন যে, কয়েকদিন আগে তিনি (মামুন) ‘আওয়ামী লীগের ফিরে আসা’ সংক্রান্ত বক্তব্য দিয়েছিলেন।
সভায় উপস্থিত জনপ্রশাসন সচিব ওই ইউএনওকে ‘তাৎক্ষণিক’ প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন বলে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোর খবরে বলা হয়।
সজলের বর্ণিত ঘটনার দিন সদরপুরের ইউএনও’র কক্ষে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও উপস্থিত ছিলেন।
‘আওয়ামী লীগ ফিরে আসবে’ এমন বক্তব্য দেয়ার অভিযোগ উঠলেও স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা ইউএনও’র পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। সংবাদ সম্মেলন এবং মানববন্ধন করে প্রতিবাদও জানিয়েছে দল দুটি।
উপজেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক কাজী বদরুজ্জামান গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, “আওয়ামী লীগ ফিরে আসবে – এমন কোনো কথা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেননি। আমি কর্মসূচির স্থান এবং উনার রুমে দুই জায়গাতেই ছিলাম।”
মি. বদরুজ্জামান যোগ করেন, “ইউএনও আল মামুন ‘উপদেশের সুরে’ বলেছিলেন, আপনারা যদি ঐক্যবদ্ধ না থাকেন তাহলে কিন্তু আওয়ামী লীগ সুযোগ পাবে ফিরে আসার।”
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা সজল মিথ্যাচার করেছেন বলে দাবি তার।
তবে আনিসুর রহমান সজলের দাবি, তিনি নিজে যা শুনেছেন তাই উপস্থাপন করেছেন সংস্কার কমিশনের মতবিনিময় সভায়। ইউএনও সরাসরি ‘আওয়ামী লীগ ফিরে আসার’ কথা বলেছেন নাকি বিশেষ পরিস্থিতিতে সেই ‘সুযোগ’ তৈরি হতে পারে বোঝাতে বলেছেন তা আলাদা করে দেখার পক্ষে নন তিনি।
“জনগণের একজন সেবক তার অফিসে বসে কোনো রাজনৈতিক কথা বলবেন কেন? আমি শুধু এই মানসিকতার সংশোধনের জন্য বলেছিলাম,” গণমাধ্যমকে বলছিলেন মি. সজল।
অবশ্য মতবিনিময় সভার ভিডিও ফুটেজে তাকে বলতে শোনা গেছে, ‘তিনি (ইউএনও) আমাদেরকে অফিসে ডেকে ছলে-কৌশলে বলার চেষ্টা করে ‘আওয়ামী লীগ উইল বি কাম ব্যাক, টুডে অর টুমরো।”
তবে, স্থানীয় কয়েকটি গণমাধ্যমে তিনি এ ধরনের কথা বলার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ ও ‘তদন্ত ছাড়াই শাস্তি’
ফরিদপুরে সংস্কার কমিশনের মতবিনিময়ে কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেসুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধির অভিযোগ শুনে মোখলেসুর রহমান ইউএনওকে তাৎক্ষণিক প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন।
তবে শেষ পর্যন্ত সেই নির্দেশ প্রতিপালিত হয়নি, প্রত্যাহার করা হয়নি ইউএনও আল মামুনকে।
স্বাভাবিক নিয়মে তার পদোন্নতি হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানান জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান মোল্যা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দা লাসনা কবির বলেন, জনপ্রশাসনে যারা আছেন, প্রথমত তাদের কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য এখতিয়ার নেই।
“এমন কোথাও কোনো রাজনৈতিক বক্তব্যও দেয়া উচিত না যেটা পাবলিক (প্রকাশিত) হতে পারে,” যোগ করেন অধ্যাপক কবির।
আবার কোনো রকম তদন্ত ছাড়া ‘তাৎক্ষণিক’ শাস্তি দেয়াও উচিত নয় বলে অভিমত তার।
“কর্মকর্তা আসলেই বলেছেন কি না, আসলেই ছাত্র প্রতিনিধি শুনেছেন কি না সেটা তো তদন্ত করে বের করে আনতে হবে। তার আগে প্রত্যাহার বা বদলির সিদ্ধান্ত কোনো অবস্থাতেই ঠিক নয়,” গণমাধ্যমকে বলেছিলেন অধ্যাপক লাসনা কবির।
শেখ হাসিনার পতনের পর সরকারি, আধা-সরকারি, এমনকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদত্যাগের হিড়িক দেখা গেছে।
এক্ষেত্রে কেউ কেউ স্বেচ্ছায় পদ ছেড়েছেন। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ, অপমান-অপদস্তসহ নানান চাপের মুখে কর্তা ব্যক্তিরা পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন।
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে দায়িত্ব ছেড়ে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ শীর্ষ পদের ব্যক্তিরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিরাও পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনাররাও।
দেশজুড়ে প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল আনা হয়। সচিব থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, ইউএনওসহ বিভিন্ন পদে পরিবর্তন আসে।
ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নয়ই সেপ্টেম্বর যোগদান করেন আল মামুন। তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ৩৪ ব্যাচের কর্মকর্তা।