ঢাকা , রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৩০ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

যার কবিতার বই পড়ে পাগল হয়েছিলেন হেলেন !

কবি হেলাল হাফিজ, যিনি তাঁর আবেগময় ও প্রগাঢ় কবিতার জন্য পরিচিত, জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর, নেত্রকোনায়। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয়, যা তাকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি এনে দেয়। তাঁর কবিতায় প্রেম, দ্রোহ, সংগ্রাম এবং মানবিকতা প্রতিফলিত হয়েছে। তার অমর পঙ্‌ক্তি “এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় / এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়” আজও আমাদের মনে জাগ্রত থাকে। এই পঙ্‌ক্তি দুটি ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকী’ কবিতার অংশ।

 

১৯৬৯ সালে যখন দেশে গণ-অভ্যুত্থান চলছিল, কবি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। একদিন রিকশায় চলার পথে, রিকশাচালক যখন মিছিলে থামলেন এবং পুলিশের ধাওয়া থেকে বাঁচতে মিছিলকারীরা পালিয়ে যাচ্ছিল, তখন তার মুখে একটি বাক্য শোনা যায়, “মার, মার শালাদের। প্রেমের জন্য কোনো কোনো সময় মার্ডারও করা যায়।” এই কথাটি কবির মনের ভিতর এক গভীর ভাবনার সৃষ্টি করেছিল। তিনি তখনই অনুভব করেন যে, “দেশপ্রেমের জন্যও তো মার্ডার করা যেতে পারে”, এবং এই ভাবনার ফলস্বরূপ তিনি রচনা করেন ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকী’ কবিতা।

 

কবি হেলাল হাফিজের জীবন ছিল এক প্রকার যন্ত্রণা এবং বিচ্ছেদের গল্প। তার শৈশবে মাকে হারান এবং বাবাও ১৯৭৩ সালে না-ফেরার দেশে চলে যান। একে একে জীবন তাঁকে একাধিক কঠিন মুহূর্তের মুখোমুখি করেছে। তার প্রেমিকা হেলেনের সঙ্গে বিচ্ছেদও ছিল তার জীবনের এক বড় ঘটনা। কিন্তু সে সময়ে তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। কষ্ট সয়ে, সহনশীলতা রেখে তিনি পরিস্থিতি সামলেছিলেন।

 

কবি তার ‘প্রতিমা’ কবিতায় বলেছেন, “অনেক কষ্টের দামে জীবন গিয়েছে জেনে / মূলতই ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়, বিরহে উজ্জ্বল।” তার কবিতার শৈলী একদিকে যেমন গভীর আবেগী, তেমনি অপরদিকে শক্তি এবং দৃঢ়তা নিয়ে ভরা। তার লেখা ‘তুমি ডাক দিলে’ কবিতার পঙ্‌ক্তি—”একবার ডাক দিয়ে দেখো আমি কতোটা কাঙাল,/ কতো হুলুস্থুল অনটন আজন্ম ভেতরে আমার”—আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এই কবিতাটি ‘আজব কারখানা’ সিনেমার গানেও রূপ নেয়।

 

কবি হেলাল হাফিজের ‘অমীমাংসিত সন্ধি’ কবিতার পঙ্‌ক্তি “তোমাকে শুধু তোমাকে চাই, পাবো?/ পাই বা না পাই এক জীবনে তোমার কাছেই যাবো” অনেকের হৃদয়ে গেঁথে আছে। এই কবিতাও জনপ্রিয় গান হিসেবে পরিণত হয়েছে, যা ‘দিন-দ্য ডে’ সিনেমায় ব্যবহৃত হয়। তার কবিতাগুলি মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে, প্রেম, বিচ্ছেদ, কষ্ট, আর ভালোবাসার সৌন্দর্যকে অনন্যভাবে তুলে ধরে।

 

হেলাল হাফিজের কবিতাগুলির গান রূপান্তরিত হয় বহু সিনেমায়, যেমন ‘আজব কারখানা’ সিনেমার গানগুলো, যেগুলো ভাইকিংস ব্যান্ডের সংগীতায়োজনে শ্রোতাদের হৃদয় জয় করেছে। তিনি ছিলেন একজন কবি, যিনি তার জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে কবিতায় পরিণত করে মানুষের অন্তরে জায়গা করে নিয়েছেন।

 

তার ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থ তাঁকে এনে দেয় এক অনন্য খ্যাতি। দীর্ঘ সময় তিনি নতুন কোনো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেননি, তবে ২০১২ সালে ‘কবিতা একাত্তর’ এবং ২০১৯ সালে ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। হেলাল হাফিজের কবিতায় আজও প্রতিটি মানুষ তার নিজের অনুভূতি, কষ্ট, এবং প্রেমের পুণর্জাগরণ পায়।

 

এত বিশাল প্রতিভার অধিকারী কবি হেলাল হাফিজ আজ আর আমাদের মধ্যে নেই, তবে তার কবিতা, তার সৃষ্টির মহিমা চিরকাল বেঁচে থাকবে আমাদের মধ্যে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

যার কবিতার বই পড়ে পাগল হয়েছিলেন হেলেন !

আপডেট সময়: ০৬:৪৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪

কবি হেলাল হাফিজ, যিনি তাঁর আবেগময় ও প্রগাঢ় কবিতার জন্য পরিচিত, জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর, নেত্রকোনায়। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয়, যা তাকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি এনে দেয়। তাঁর কবিতায় প্রেম, দ্রোহ, সংগ্রাম এবং মানবিকতা প্রতিফলিত হয়েছে। তার অমর পঙ্‌ক্তি “এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় / এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়” আজও আমাদের মনে জাগ্রত থাকে। এই পঙ্‌ক্তি দুটি ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকী’ কবিতার অংশ।

 

১৯৬৯ সালে যখন দেশে গণ-অভ্যুত্থান চলছিল, কবি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। একদিন রিকশায় চলার পথে, রিকশাচালক যখন মিছিলে থামলেন এবং পুলিশের ধাওয়া থেকে বাঁচতে মিছিলকারীরা পালিয়ে যাচ্ছিল, তখন তার মুখে একটি বাক্য শোনা যায়, “মার, মার শালাদের। প্রেমের জন্য কোনো কোনো সময় মার্ডারও করা যায়।” এই কথাটি কবির মনের ভিতর এক গভীর ভাবনার সৃষ্টি করেছিল। তিনি তখনই অনুভব করেন যে, “দেশপ্রেমের জন্যও তো মার্ডার করা যেতে পারে”, এবং এই ভাবনার ফলস্বরূপ তিনি রচনা করেন ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকী’ কবিতা।

 

কবি হেলাল হাফিজের জীবন ছিল এক প্রকার যন্ত্রণা এবং বিচ্ছেদের গল্প। তার শৈশবে মাকে হারান এবং বাবাও ১৯৭৩ সালে না-ফেরার দেশে চলে যান। একে একে জীবন তাঁকে একাধিক কঠিন মুহূর্তের মুখোমুখি করেছে। তার প্রেমিকা হেলেনের সঙ্গে বিচ্ছেদও ছিল তার জীবনের এক বড় ঘটনা। কিন্তু সে সময়ে তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। কষ্ট সয়ে, সহনশীলতা রেখে তিনি পরিস্থিতি সামলেছিলেন।

 

কবি তার ‘প্রতিমা’ কবিতায় বলেছেন, “অনেক কষ্টের দামে জীবন গিয়েছে জেনে / মূলতই ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়, বিরহে উজ্জ্বল।” তার কবিতার শৈলী একদিকে যেমন গভীর আবেগী, তেমনি অপরদিকে শক্তি এবং দৃঢ়তা নিয়ে ভরা। তার লেখা ‘তুমি ডাক দিলে’ কবিতার পঙ্‌ক্তি—”একবার ডাক দিয়ে দেখো আমি কতোটা কাঙাল,/ কতো হুলুস্থুল অনটন আজন্ম ভেতরে আমার”—আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এই কবিতাটি ‘আজব কারখানা’ সিনেমার গানেও রূপ নেয়।

 

কবি হেলাল হাফিজের ‘অমীমাংসিত সন্ধি’ কবিতার পঙ্‌ক্তি “তোমাকে শুধু তোমাকে চাই, পাবো?/ পাই বা না পাই এক জীবনে তোমার কাছেই যাবো” অনেকের হৃদয়ে গেঁথে আছে। এই কবিতাও জনপ্রিয় গান হিসেবে পরিণত হয়েছে, যা ‘দিন-দ্য ডে’ সিনেমায় ব্যবহৃত হয়। তার কবিতাগুলি মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে, প্রেম, বিচ্ছেদ, কষ্ট, আর ভালোবাসার সৌন্দর্যকে অনন্যভাবে তুলে ধরে।

 

হেলাল হাফিজের কবিতাগুলির গান রূপান্তরিত হয় বহু সিনেমায়, যেমন ‘আজব কারখানা’ সিনেমার গানগুলো, যেগুলো ভাইকিংস ব্যান্ডের সংগীতায়োজনে শ্রোতাদের হৃদয় জয় করেছে। তিনি ছিলেন একজন কবি, যিনি তার জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে কবিতায় পরিণত করে মানুষের অন্তরে জায়গা করে নিয়েছেন।

 

তার ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থ তাঁকে এনে দেয় এক অনন্য খ্যাতি। দীর্ঘ সময় তিনি নতুন কোনো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেননি, তবে ২০১২ সালে ‘কবিতা একাত্তর’ এবং ২০১৯ সালে ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। হেলাল হাফিজের কবিতায় আজও প্রতিটি মানুষ তার নিজের অনুভূতি, কষ্ট, এবং প্রেমের পুণর্জাগরণ পায়।

 

এত বিশাল প্রতিভার অধিকারী কবি হেলাল হাফিজ আজ আর আমাদের মধ্যে নেই, তবে তার কবিতা, তার সৃষ্টির মহিমা চিরকাল বেঁচে থাকবে আমাদের মধ্যে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।