ঢাকা , রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৩০ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

গোয়েন্দাজালে নৈশভোটের কুশীলব ১১৬ ডিসি-এসপি

 

 

বিগত নির্বাচনে তৎকালীন সরকারদলীয় প্রার্থীদের জিতিয়ে দেওয়ার নেপথ্যের আলোচিত-সমালোচিত ডিসি-এসপিরা আবারও আলোচনায়। এবার তাঁদের ফাইল ধরে টান দিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের কর গোয়েন্দারা। রাতের ভোটের কারিগর বলে পরিচিত এসব ডিসি-এসপির বিপুল অঙ্কের অবৈধ আয়ের কর ফাঁকি অনুসন্ধানে সংস্থাটির আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট ব্যাপক আয়োজনে মাঠে নেমেছে। তাদের তৈরি ১১৬ ডিসি-এসপির তালিকা প্রকাশ করেছে  কালের কণ্ঠ।

 

ভোটের মাঠে যাদেরকে ‘মাস্টারমাইন্ড’ বলা হয়, তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক অভিযোগ। অনেকেই অভিযোগ করেন, তাঁরা পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে নির্বাচনের আগের রাতেই ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’-এ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বিশেষত ২০১৮ সালের নির্বাচনে তাঁদের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে আলোচিত। তখন এই ডিসি-এসপিরা সরকারদলীয় প্রার্থীদের জন্য ‘হ্যান্ডসাম অ্যামাউন্ট’ গ্রহণের অভিযোগে অভিযুক্ত হন।

 

সম্প্রতি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর কর গোয়েন্দারা এই ১১৬ ডিসি-এসপির অবৈধ আয়ের তদন্তে মাঠে নেমেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে কর ফাঁকি, আয়কর যাচাই-বাছাই, এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান করা হচ্ছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় এই ডিসি-এসপিরা ৫৭ জন ডিসি এবং ৫৯ জন এসপি হিসেবে নির্বাচনে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। সরকারের পতনের পরও এরা প্রশাসনে বহাল ছিলেন এবং অনেকেই এখনো গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন।

 

এনবিআরের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জনমানুষের ক্ষোভ ছিল এবং এখন তা প্রকাশ্যে এসেছে। তারা আয়ের নথি যাচাই করে, অবৈধ আয়ের পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেবেন। অতিরিক্ত সম্পদ বা দুর্নীতির তথ্য পেলে তা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এ পাঠানো হবে।

 

২০১৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের মাত্র ২২টি আসনে জয় নিশ্চিত ছিল, এবং বাকি আসনগুলিতে অন্য দলগুলির সম্ভাবনা ছিল। তবে ডিসি-এসপিরা নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

 

এ প্রসঙ্গে সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান মন্তব্য করেছেন, এনবিআরের উচিত শুধু ডিসি-এসপিদের তদন্ত নয়, বরং দেশের অন্যান্য ক্ষেত্রেও যেসব ব্যত্যয় ও দুর্নীতি হয়েছে তা অনুসন্ধান করা।

এনবিআরের সাবেক সদস্য ড. সৈয়দ আমিনুল করিম বলেন, দেশের যেসব কর ফাঁকি দেওয়া ব্যক্তি লুকিয়ে আছেন, তাদের খুঁজে বের করাই প্রধান কাজ।

 

আলোচিত ৫৭ ডিসি:

১. ময়মনসিংহে – ড. সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস
২. নেত্রকোনায় – মঈনউল ইসলাম
৩. জামালপুরে – আহমেদ কবীর
৪. শেরপুরে – আনার কলি মাহবুব
৫. সিলেটে – এম কাজী এমদাদুল ইসলাম
৬. সুনামগঞ্জে – মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ
৭. মৌলভীবাজারে – মো. তোফায়েল ইসলাম
৮. হবিগঞ্জে – মাহমুদুল কবীর মুরাদ
৯. ঢাকায় – আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান
১০. গাজীপুরে – ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর
…এভাবে আরও অনেক জেলা।

 

আলোচিত ৫৯ জন এসপি:

১. পঞ্চগড়ের – এস এম সিরাজুল হুদা
২. ঠাকুরগাঁওয়ের – উত্তম প্রসাদ পাঠক
৩. দিনাজপুরে – শাহ ইফতেখার আহমেদ
৪. নীলফামারীতে – মোহাম্মদ গোলাম সবুর
৫. রংপুরে – মো. ফেরদৌস আলী চৌধুরী
৬. গাইবান্ধায় – মো. কামাল হোসেন
৭. জয়পুরহাটে – মোহাম্মদ নূরে আলম
…এভাবে আরও অনেক জেলার এসপি।

 

বিতর্কিতদের যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন:

১. মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জেলা ও মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগের যুগ্ম সচিব – আনারকলি মাহবুব
২. রাজউকের সদস্য (পরিকল্পনা) – মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ
৩. কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব – ড. সাবিনা ইয়াসমিন
৪. পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব – মো. হামিদুল হক
৫. বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে – মতিউল ইসলাম চৌধুরী, মাহমুদুল আলম, হায়াত-উদ-দৌলা খান
৬. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব – অঞ্জন চন্দ্র পাল
৭. শিল্প মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব – মো. মাজেদুর রহমান খান
৮. মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব – মোহাম্মদ মোখলেসুর রহমান
…এভাবে অন্যান্য মন্ত্রণালয় এবং সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন।

এনবিআরের অনুসন্ধান এবং তদন্তে এসব কর্মকর্তাদের অবৈধ সম্পদ, আয়কর ফাঁকি এবং দুর্নীতির বিষয়গুলি উন্মোচিত হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গোয়েন্দাজালে নৈশভোটের কুশীলব ১১৬ ডিসি-এসপি

আপডেট সময়: ০৩:০২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারী ২০২৫

 

 

বিগত নির্বাচনে তৎকালীন সরকারদলীয় প্রার্থীদের জিতিয়ে দেওয়ার নেপথ্যের আলোচিত-সমালোচিত ডিসি-এসপিরা আবারও আলোচনায়। এবার তাঁদের ফাইল ধরে টান দিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের কর গোয়েন্দারা। রাতের ভোটের কারিগর বলে পরিচিত এসব ডিসি-এসপির বিপুল অঙ্কের অবৈধ আয়ের কর ফাঁকি অনুসন্ধানে সংস্থাটির আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট ব্যাপক আয়োজনে মাঠে নেমেছে। তাদের তৈরি ১১৬ ডিসি-এসপির তালিকা প্রকাশ করেছে  কালের কণ্ঠ।

 

ভোটের মাঠে যাদেরকে ‘মাস্টারমাইন্ড’ বলা হয়, তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক অভিযোগ। অনেকেই অভিযোগ করেন, তাঁরা পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে নির্বাচনের আগের রাতেই ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’-এ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বিশেষত ২০১৮ সালের নির্বাচনে তাঁদের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে আলোচিত। তখন এই ডিসি-এসপিরা সরকারদলীয় প্রার্থীদের জন্য ‘হ্যান্ডসাম অ্যামাউন্ট’ গ্রহণের অভিযোগে অভিযুক্ত হন।

 

সম্প্রতি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর কর গোয়েন্দারা এই ১১৬ ডিসি-এসপির অবৈধ আয়ের তদন্তে মাঠে নেমেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে কর ফাঁকি, আয়কর যাচাই-বাছাই, এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান করা হচ্ছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় এই ডিসি-এসপিরা ৫৭ জন ডিসি এবং ৫৯ জন এসপি হিসেবে নির্বাচনে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। সরকারের পতনের পরও এরা প্রশাসনে বহাল ছিলেন এবং অনেকেই এখনো গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন।

 

এনবিআরের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জনমানুষের ক্ষোভ ছিল এবং এখন তা প্রকাশ্যে এসেছে। তারা আয়ের নথি যাচাই করে, অবৈধ আয়ের পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেবেন। অতিরিক্ত সম্পদ বা দুর্নীতির তথ্য পেলে তা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এ পাঠানো হবে।

 

২০১৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের মাত্র ২২টি আসনে জয় নিশ্চিত ছিল, এবং বাকি আসনগুলিতে অন্য দলগুলির সম্ভাবনা ছিল। তবে ডিসি-এসপিরা নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

 

এ প্রসঙ্গে সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান মন্তব্য করেছেন, এনবিআরের উচিত শুধু ডিসি-এসপিদের তদন্ত নয়, বরং দেশের অন্যান্য ক্ষেত্রেও যেসব ব্যত্যয় ও দুর্নীতি হয়েছে তা অনুসন্ধান করা।

এনবিআরের সাবেক সদস্য ড. সৈয়দ আমিনুল করিম বলেন, দেশের যেসব কর ফাঁকি দেওয়া ব্যক্তি লুকিয়ে আছেন, তাদের খুঁজে বের করাই প্রধান কাজ।

 

আলোচিত ৫৭ ডিসি:

১. ময়মনসিংহে – ড. সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস
২. নেত্রকোনায় – মঈনউল ইসলাম
৩. জামালপুরে – আহমেদ কবীর
৪. শেরপুরে – আনার কলি মাহবুব
৫. সিলেটে – এম কাজী এমদাদুল ইসলাম
৬. সুনামগঞ্জে – মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ
৭. মৌলভীবাজারে – মো. তোফায়েল ইসলাম
৮. হবিগঞ্জে – মাহমুদুল কবীর মুরাদ
৯. ঢাকায় – আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান
১০. গাজীপুরে – ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর
…এভাবে আরও অনেক জেলা।

 

আলোচিত ৫৯ জন এসপি:

১. পঞ্চগড়ের – এস এম সিরাজুল হুদা
২. ঠাকুরগাঁওয়ের – উত্তম প্রসাদ পাঠক
৩. দিনাজপুরে – শাহ ইফতেখার আহমেদ
৪. নীলফামারীতে – মোহাম্মদ গোলাম সবুর
৫. রংপুরে – মো. ফেরদৌস আলী চৌধুরী
৬. গাইবান্ধায় – মো. কামাল হোসেন
৭. জয়পুরহাটে – মোহাম্মদ নূরে আলম
…এভাবে আরও অনেক জেলার এসপি।

 

বিতর্কিতদের যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন:

১. মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জেলা ও মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগের যুগ্ম সচিব – আনারকলি মাহবুব
২. রাজউকের সদস্য (পরিকল্পনা) – মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ
৩. কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব – ড. সাবিনা ইয়াসমিন
৪. পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব – মো. হামিদুল হক
৫. বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে – মতিউল ইসলাম চৌধুরী, মাহমুদুল আলম, হায়াত-উদ-দৌলা খান
৬. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব – অঞ্জন চন্দ্র পাল
৭. শিল্প মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব – মো. মাজেদুর রহমান খান
৮. মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব – মোহাম্মদ মোখলেসুর রহমান
…এভাবে অন্যান্য মন্ত্রণালয় এবং সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন।

এনবিআরের অনুসন্ধান এবং তদন্তে এসব কর্মকর্তাদের অবৈধ সম্পদ, আয়কর ফাঁকি এবং দুর্নীতির বিষয়গুলি উন্মোচিত হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।